— মোঃ মহিউদ্দিন
বাংলার প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব খাবারের সংস্কৃতি আছে, যার শেকড় প্রোথিত আছে স্থানীয় প্রকৃতি ও জীবনযাপনের সঙ্গে। ভোলা জেলার এমনই এক অমূল্য রসদ হলো হোগলের গুঁড়ি, যা তৈরি হয় হোগলা গাছের ফুলের রেণু থেকে। এটি শুধু স্বাদে অনন্য নয়, বরং পুষ্টিগুণেও সমৃদ্ধ। শীতের সকালে খেজুরের রসের সঙ্গে কিংবা দুধ-নারিকেল-চিনির সংমিশ্রণে রান্না করা হোগলের পায়েস ও পিঠার স্বাদ একবার মুখে লাগলে তা সহজে ভোলার নয়।
হোগলা গাছ ও তার বিস্তার—
ভোলা জেলার চরাঞ্চল ও খালপাড়ে অবাধে জন্মানো তৃণজাতীয় উদ্ভিদ হোগলা গাছ একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে, অন্যদিকে স্থানীয় জীবিকার অন্যতম সহায়।
ভোলা জেলার চরফ্যাশন, মাঝেরচর সহ বিভিন্ন এলাকায় বছরের নির্দিষ্ট সময় জোয়ার-ভাটার খেলা চলে। এই জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য হোগলা গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। বর্ষাকালে গাছে ফুল ফোটে, আর এই ফুল থেকেই পাওয়া যায় হলুদাভ গুঁড়োর মতো এক আশ্চর্য উপাদান—হোগলের গুঁড়ি।
সংগ্রহ ও প্রস্তুতির প্রক্রিয়া—-
বর্ষাকালে হোগলার ফুলের রেণু সংগ্রহ করা হয়। সূর্যের তীব্র উত্তাপে শুকিয়ে নেওয়ার পর তা তৈরি হয় নানা রকম খাবারের উপকরণ হিসেবে। স্থানীয় হাটবাজারে পাওয়া গেলেও বর্তমানে এর জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়েছে যে শহরের অভিজাত বিপণিতেও এটি উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে।
হোগলের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি খাবারের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি পদ হলো পায়েস ও নকশী পিঠা।
হোগলের গুঁড়ির পায়েস তৈরির রন্ধনপ্রণালী—
হোগলের গুঁড়ি দিয়ে পায়েস তৈরিতে দরকার হয় খাঁটি দুধ, চিনি বা গুঁড়, নারিকেল কুঁচি , মসলা, তেজপাতা এবং সামান্য লবণ।
১. প্রথমে একটি পাত্রে দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করা হয়।
২. হোগলের গুঁড়ি আস্তে আস্তে যোগ করে ক্রমাগত নাড়তে হয়, যাতে দলা না বেঁধে যায়।
৩. যখন দুধ ও হোগলের মিশ্রণ ঘন হতে শুরু করবে, তখন চিনি বা খেজুরের গুঁড় দেওয়া হয়।
৪. শেষে নারিকেল কুঁচি ও অল্প লবণ দিয়ে নামিয়ে ফেলা হয়।
কয়লার আগুনে ধীর তাপে রান্না করলে এই পায়েসে এক অদ্ভুত ধরণের মিষ্টি সুঘ্রাণ তৈরি হয়, যা স্বাদগ্রহণকারীর স্মৃতিতে দীর্ঘসময় লেগে থাকে।
হোগলের গুঁড়ির পিঠার ঐতিহ্য—
ভোলার বাড়িঘরে শীতকাল এলেই শুরু হয় পিঠা তৈরির ধুম। চালের গুঁড়ির সঙ্গে হোগলের গুঁড়ি মিশিয়ে নানান নকশায় পিঠা বানানো হয়। নরম, তুলতুলে এই পিঠাগুলো যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনই সুস্বাদু।
একসময় কেবলমাত্র ভোলা জেলার গ্রামীণ পরিবারগুলোর ঐতিহ্যবাহী খাবার হলেও, এখন এটি শহরের মানুষের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে বিদেশে হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি রশি ও অন্যান্য সামগ্রী রপ্তানি বৃদ্ধির কারণে, হোগলা চাষের পরিমাণ বেড়েছে, যা হোগলের গুঁড়ির সহজলভ্যতা বাড়িয়েছে।
স্বাদ ও পুষ্টিগুণের সংমিশ্রণ—
হোগলের গুঁড়ির স্বাদে এক ধরণের নরম মিষ্টত্ব আছে, যা স্বাভাবিক চিনির চেয়ে অনেক বেশি সূক্ষ্ম। এটি প্রাকৃতিকভাবে আঁশসমৃদ্ধ ও সহজপাচ্য, তাই স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী।
পুষ্টিগুণের কথা বললে, এতে রয়েছে—
✅ উচ্চমাত্রার ফাইবার, যা হজমে সহায়ক।
✅ প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
✅ কম ক্যালোরিযুক্ত, তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও তুলনামূলকভাবে নিরাপদ।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা—
হোগলের গুঁড়ি ও এর তৈরি খাবার নিয়ে ভোলা জেলাবাসীর রয়েছে গর্ব করার মতো ঐতিহ্য। বর্তমানে এটি কেবল গ্রামীণ জনপদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং শহরের বাজারেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ ধরণের প্রাকৃতিক ও ঐতিহ্যবাহী খাবার সংরক্ষণ ও প্রসারের মাধ্যমে বাংলাদেশের লোকখাদ্যের বৈচিত্র্য আরও সমৃদ্ধ হতে পারে।
এক সময় হয়তো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে “ভোলার হোগলের পায়েস” বিশেষ ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পাবে, সেই আশাই করা যায়।
শেষ কথা—
ভোলার মাটির সোঁদা গন্ধ আর জোয়ার-ভাটার সঙ্গে গড়ে ওঠা জীবনধারার প্রতিচ্ছবি এই হোগলের গুঁড়ির পায়েস ও পিঠা। এটি শুধু একধরনের খাবার নয়, বরং ভোলার মানুষের কষ্টার্জিত সংগ্রামের এক মিষ্টি ফসল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো আধুনিকতার ছোঁয়ায় নতুন নতুন খাবার আসবে, তবে হোগলের গুঁড়ির এই ঐতিহ্য মুছে যাওয়ার নয়।
লেখক# কবি , সাহিত্যিক , প্রফেসর