স্টাফ রিপোর্টার ভোলা প্রকাশঃ
ভোলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুরে প্রতিপক্ষকে গ্রামছাড়া করতে হত্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে। আমির হোসেন মাঝি নামে এক ব্যক্তির স্বাভাবিক মৃত্যুকে হত্যা বলে সাজিয়ে মামলা দায়ের করা হয়। হত্যা মামলা দায়ের করায় দৌলতখান থানা পুলিশ বিল্লাহ হোসেন নামে আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। এ ঘটনায় এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পর ইউ সদস্য সহ নিরীহ হত-দরিদ্র ব্যক্তিদের
জড়িয়ে হত্যা মামলা দায়ের করায় ফুঁসে উঠেছে গ্রামবাসী।
১০ জানুয়ারী দুপুরে ভোলার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে বুকে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়ে মারা যান মদনপুরের আমির হোসেন মাঝি (৬৫)। এ ঘটনায় ১১ ফেব্রুয়ারী দৌলতখান থানায় হত্যা মামলা দায়ের হয়। পুলিশ মামলার ১২ আসামীর মধ্যে মো. বেল্লাল হোসেন (৪৫) নামের এক চায়ের দোকানদারকে ভোলা সদর উপজেলার নাছিমাঝি এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে। যিনি ঘটনার সময় তার চায়ের দোকানে ছিলেন।
সরেজমিন ঘুরে, মামলার আসামী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গ্রাম পুলিশ ও মদনপুরবাসিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁরা আরও জানান, ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর ভোলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৭নম্বর ওয়ার্ডে ইউপি সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দীতা করেন, বসির আহমেদ মাঝি। তিনি নির্বাচনে ব্যাপক টাকা খরচ করে পরাজয় বরণ করে নির্বাচিত মো. হেলাল উদ্দিন মাষ্টারের ওপর ক্ষুব্ধ হন। বসির আহমেদ মাঝি ও
তাঁর ভাই মদনপুরের গ্রাম পুলিশ মো. নাসির চৌকিদার মিলে প্রতিপক্ষ হেলাল উদ্দিন মাষ্টার ও তাঁর সমর্থকদের ফাঁসাতে নানা রকম ষড়যন্ত্র শুরু করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বসির মাঝি তাঁর সমর্থক আনোয়ার হোসেনকে দিয়ে হেলাল উদ্দিন মাষ্টার ও তাঁর ১১জন সমর্থককে মিথ্যা হত্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে। এসব নিরীহ, অসহায় ব্যক্তি পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানোর কারণে তাঁদের সংসারে চুলোয় হাড়ি চড়ছে না।
মদনপুরের ইউপি সদস্য হেলালউদ্দিন মাষ্টার বলেন, বসির আহমেদ মাঝি নির্বাচনে হেরে তাঁর সমর্থকদের ওপর ৩-৪ দফায় হামলা করেছে। হত্যা মামলাসহ তিনটি মামলা করেছে। আশা করি সবগুলোই মিথ্যা প্রমানিত হবে।
তবে, বসির আহমেদ মাঝি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ভোট করতে গেলে টাকা খরচ হয়, এটা সবারই জানা। সে কারণে তাঁর ওপর কোনো ক্ষোভ নেই। তিনি কাউকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসাননি। তিনি এসব ঘটনার মধ্যেও নেই, তিনি নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছেন। তার ভাই চৌকিদার, তাকে পুলিশ ডাকে, তাই যায়। অন্য কিছু নয়।
১০ ফেব্রুয়ারী দুপুরে ভোলা ২৫০শয্যা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা(আরএমও) মৃত্যুর প্রমানপত্রে লিখেছেন, ‘a cardiogenic shock due to a MI । লেখাটির অর্থ জানতে চাইলে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা(আরওএমও) মো. তায়েবুর রহমান বলেন, রোগী হৃদরোগে মারা গেছে।
মামলার এজাহারে মো. আনোয়ার হোসেন(২৩) লিখেছেন, তাঁর বাবা আমির হোসেন মাঝি (৬৫) ও মো. ছালেম হাওলাদার(৬০) দুজনই মদনপুর ইউনিয়নের চরমুন্সি গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর বাবা আমির হোসেন ট্রাক্টর দিয়ে ছালেম হাওলাদারের জমি চাষ করে ২০হাজার টাকা পাওনা হয়। ওই টাকা চাইতে গেলেই ছালেম হাওলাদার হত্যার হুমকী দেয়। ৩ফেব্রুয়ারী রাত সাড়ে ১০টার দিকে খুন-জখমের উদ্দেশ্যে মো. ছালেম হাওলাদারের নেতৃত্বে ৭নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন মাষ্টার, মো. বাচ্চু, মো. মিরাজ, মো. মিরাজ, আমির হাওলাদার, মো. হারুন, নুর ইসলাম, মো. বিল্লাল, মো. এনামুল হক রমজান, মো. নুরে আলম মাঝি ও মো. রুবেল আমির হোসেনকে কুপিয়ে-পিটিয়ে জখম করে। এ সময় তাঁর বাড়িতে কেউ ছিল না। পরের দিন ৪ফেব্রুয়ারী দুপুর দুইটার দিকে বাদি ও তাঁর মা নোয়াখালী থেকে এসে আমিরকে চিকিৎসার জন্য ভোলার ২৫০শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং ৫ফেব্রুয়ারী বাড়িতে নিয়ে আসেন। ১০ফেব্রুয়ারী দুপুরে পুনরায় অসুস্থ হলে আমির হোসেনকে পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
মদনপুর ইউপি চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন (নান্নু ডাক্তার), ইউপি সদস্য ফারুক দৌলতসহ প্রত্যক্ষদর্শী গ্রাম পুলিশ ও গ্রামবাসী জানান, মামলার এজাহারের বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যা। প্রকৃত ঘটনা-ছালেম হাওলাদার আমির হোসেন মাঝির নিকট জমি লগ্নির ৩০হাজার টাকা পাওনা আছে। ৩বছর ধরে টাকা না দেওয়ায় ছালেম আমির হোসেনের ৪টি ভেড়া আটকে রাখে। পুলিশ ৩ফেব্রুয়ারী ওই ভেড়া উদ্ধার করে আমির হোসেনকে বুঝিয়ে দেয়। ওই দিনই আমির হোসেনের ছেলে আনোয়ার হোসেন স্থানীয় হারুন (৪৮) ভুইয়ার ছেলে সেলিম ভুইয়াকে (২০) কথা কাটাকাটির জের ধরে মারধর করে। কেনো মারলো এটা জানতে ছালেম হাওলাদার, মো. সেলিম, মো. বাচ্চু ও মো. মিরাজ আমির হোসেনের বাড়িতে যায়। আমির হোসেন পক্ষ আগ থেকেই বিষয়টি বুঝতে পেড়ে বাড়িতে লাঠিছোটা, ধারালো অস্ত্র ও মরিচের গুড়া সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখে। ছালেম হাওলাদার আসার সঙ্গে তাদের চোখে-মুখে মরিচেরগুলো ছিটিয়ে এলাপাতাড়িয়ে পিটিয়ে জখম করে। এ সময় আমির হোসেন মাথায় আঘাত পান। স্থানীয়রা গুরুতর আহতদের উদ্ধার করে রাত সাড়ে ১২টার সময় ভোলার ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করে। স্থানীয়রা এ সময় আমির হোসেনকে হাসপাতালে নিতে চাইলে তিনি যেতে চায়নি। পরে কুবুদ্ধি পেয়ে মামলা সাজানোর জন্য আমির হোসেন ৪ফেব্রুয়ারী হাসপাতালে ভর্তি হয়। কিন্তু আঘাত গুরুতর না হওয়ায় চিকিৎসক তাকে ওই দিনই ছাড়পত্র দেন।
ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিন বলেন, ৩ ফেব্রুয়ারীর ঘটনায় সবাই মামলা করতে চাইলে তিনি মামলা করতে দেননি। ১১ফেব্রুয়ারী সালিশ ডাকেন। সালিশে সমঝোতা করে দেবেন। আমির হোসেন মাঝি সালিশে তার পক্ষের লোকদের উপস্থিত রাখার জন্য চরে রোদের মধ্যে হেঁটে হেটে দাওয়াত গিয়ে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। দুপুরের দিকে বুকে ব্যথা করছে বলে মদনপুর ইউনিয়নের পাটওয়ারী বাজারে বসে পড়েন। পরে স্থানীয়রা হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এখন নিরীহ লোকদের আসামী করে হয়রানী করা হচ্ছে।
দৌলতখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাকির হোসেন বলেন, এখন মামলা হয়েছে, তদন্তে যা আসবে, সে ভাবেই আদালতে প্রতিবেদন দাখিল হবে