মোঃ সাইফুল ইসলাম আকাশ
কন্ট্রিবিউটিং প্রতিবেদক,ভোলা:
ভোলায় ২৯ মে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ৩০ মে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া গভীর নিন্মচাপের প্রভাবে প্রচন্ড বৃষ্টি ও বাতাসে জেলায় ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
জানা গেছে,ভোলায় সদর উপজেলার ইলিশা লঞ্চ ও ফেরিঘাট,কাচিয়া মাঝের চর এর বিভিন্ন এলাকা,ভোলার শিবপুর ইউনিয়নের সুইচগেট এলাকা,বেড়িবাঁধ ভেঙে ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর, পশ্চিম ইলিশা, পূর্ব ইলিশার বিভিন্ন ইউনিয়ন,দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ও চরপাতা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা,ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার হাকিমউদ্দিন বাজারসংলগ্ন বেড়িবাঁধ ভেঙে গেলে হাসান নগর ও টগবি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয় এবং উপজেলার সাচরা ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা,ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার খেজুরগাছিয়া বেড়িবাঁধ ভেঙে পড়ায় হাজারীগঞ্জ ও জাহানপুর ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ ঝুঁকির মুখে পড়েছেন। চর কুকরি-মুকরি, ঢালচর ও চরপাতিলা এলাকায় পাঁচ ফুট পর্যন্ত পানিতে প্লাবিত হয় চরাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ, রমাগঞ্জ, ধলীগৌরনগর, চরভূতা ও পশ্চিম চরউমেদ ইউনিয়নসহ আরও কয়েকটি এলাকায় ২০টি বসতঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি আরও অন্তত ৫শ’ টি বসতঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের পূর্ব সৈয়দাবাদ এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে দুইটি গ্রাম ও অতিবৃষ্টিপাত এবং জোয়ারের পানির কারণে চরকচুয়াখালী এবং পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানিতে ভেসে গেছে পঞ্চাশেরও অধিক পুকুরের মাছ। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রচন্ড বাতাসের প্রভাবে উপড়ে গেছে নানা প্রজাতির গাছপালা।
বাজারে অটোচালক আব্দুর রহিম বলেন, দৈনিক ৩শত থেকে ৪শত টাকার মতো আয় করি। এই আয়ে চলে বৃদ্ধা মা ও স্ত্রীসহ দুই সন্তানকে নিয়ে সংসার। গত ৩ মাস আগে বিভিন্ন এনজিও থেকে প্রায় ১ লাখ টাকার মতো ঋণ নিয়ে জরাজীর্ণ বসত ঘরটি টিন দিয়ে নতুনভাবে তৈরি করি। তবে বৃহস্পতিবার বিকেলে হঠাৎ প্রচন্ড বেগে বৃষ্টি ও বাতাস শুরু হয়। এতে আমার টিনশেড ঘরটি ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে যায়। তখন অল্পের জন্য পরিবারের সবাই প্রাণে রক্ষা পাই। এরপর রাতে এক প্রতিবেশীর ঘরে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় নেই। এমনেতেই আমি ঋণগ্রস্ত, এখন নতুন করে এ ঘরটি কিভাবে করবো, তাই ভেবে কূল পাচ্ছি না। আর ঘর তুলতে না পারলে প্রতিবেশীর ঘরেই বা কতদিন থাকতে পারবো। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ করছি; ঘরটি পুনর্নির্মাণের জন্য আমাকে দ্রুত সহযোগিতা করার।
একইদিন বৃষ্টি আর বাতাসের তা-বে ওই এলাকার উকিন্দ চন্দ্র রবিদাসের ঘরের চালা উড়ে যায়। গাছের ডাল ভেঙে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় একই এলাকার সুবাশ চন্দ্র মজুমদারের ঘরের বারান্দা। এতে তার স্ত্রী শিখা রাণী মজুমদার মাথায় আঘাত পান। উকিন্দ চন্দ্র এবং সুবাশ চন্দ্রও পেশায় মুচি। তারাও ঋণগ্রস্ত। নতুন করে ঘর মেরামতের সাধ্য নেই বলে দাবি তাদের। এজন্য তারা ঘর মেরামতের জন্য সরকারি সহযোগিতা কামনা করছেন।
এদিকে একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরার কলাতলী এলাকায় বেড়িবাঁধে ব্যাপক ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।
মনপুরার বেড়িবাঁধের বাহিরে মাষ্টার হাট, আনন্দ বাজার, দক্ষিণ সাকুচিয়া, রহমানপুর, আন্দিরপাড়সহ বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে জনদূর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে।
দক্ষিণ সাকুচিয়া রহমানপুর গ্রামের বেড়িবাঁধ এর অবস্থা খুব খারাপ থাকা স্থানীয়দের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে আতংক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৃহস্পতিবার ১টার পর থেকে মনপুরা থেকে বিচ্ছিন্ন চর কলাতলি ইউনিয়নে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪-৫ ফুট পানি বেড়ে যায়। এতে এসব এলাকার দোকান ও বসতিগুলো অনেকটাই ডুবে গেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ ও গবাদি পশু।
বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানি সহজেই ঢুকে পড়ে। কলাতলি,কাজির চর, ঢালচরসহ প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
তজুমদ্দিন ও চর জহিরউদ্দিনেও বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। নদীর জলোচ্ছ্বাসে একাধিক বেড়িবাঁধ হুমকির মুখে রয়েছে,স্লুইসগেট এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে বাড়িঘর ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ভোলার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতে জরুরি ভিত্তিতে জিওব্যাগ ফেলা হচ্ছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলার বেড়িবাঁধগুলো তদারকিতে রাখা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে নদী উত্তাল থাকায় ভোলার সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সব ধরনের লঞ্চ ও ফেরি এখন পর্যন্ত চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
ভোলার ইলিশা নৌবন্দরের বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তা রিয়াদ হোসেন বলেন, প্রবল ঝড়ে ইলিশা টার্মিনালের চালা উড়ে গেছে এবং পন্টুন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকবে তবে শুক্রবার সকাল থেকে ইলিশা রুটে নৌ চলাচল কিছুটা স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানা গেছে।
ভোলা জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান জানান,৩০ শে মে শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত ভোলার বিভিন্ন উপজেলার ১০৮ টি ঘর পুরোই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে এবং জেলার ৫২ হাজার ৫৬৫ টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।এ সময় তিনি বলেন,ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় ৮৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্র ও ১৪টি মাটির কেল্লা প্রস্তুত রাখা হয়েছিল যার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষ সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া সিপিপি ও রেড ক্রিসেন্টের ১৩ হাজার ৮০০ স্বেচ্ছাসেবী এবং ৯৭টি মেডিকেল টিম এখন পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন,জেলায় মোট ২৯১ মেট্রিক টন চাল, দেড় হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও পাঁচ লাখ টাকার শিশু খাদ্য মজুত রাখা হয়েছিল সেখান থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের বিতরণ করা হয়েছে।
ভোলা জেলা প্রশাসক আজাদ জাহান আরো বলেন,সকাল থেকে ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি এবং ৭ উপজেলার সকল ইউএনওকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।