মোঃ মহিউদ্দিন সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার ভোলা প্রকাশঃ
ভোলা – বাংলাদেশের একটি দ্বীপ জেলা, যেটি এক সময় ছিল সবুজ শস্যের মাঠ, নদীর টানে গড়া জীবনযাপন আর মাটির ঘরে গড়া হাজারো মানুষের স্মৃতি। আজ সেই ভূখণ্ডের এক বড় অংশ নিঃশব্দে গিলে খেয়েছে মেঘনা নদী। দীর্ঘ সময় ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন বাস্তবতায় ভোলা জেলার হাজার হাজার মানুষ হারিয়ে ফেলেছেন তাদের ঘরবাড়ি, কৃষিজমি, জীবিকা – এবং সবচেয়ে বড় কথা, নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব।
নদীভাঙন ও বাস্তুচ্যুতির ভয়াবহ চিত্র—
গত এক দশকে ভোলার নদীতীরবর্তী বহু গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়।
প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে তীব্র নদীভাঙনের ফলে বহু পরিবার একাধিকবার ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্যত্র পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে। বাস্তবতা এতটাই কঠিন যে কেউ কেউ বলে থাকেন, “ভাঙনের আগে মৃত্যু হলেও ভালো হতো, অন্তত এই অনিশ্চিত জীবনটা দেখতে হতো না।”
মোঃ শাহেদ (৪৫), এক সময়ের ভোলা সদর উপজেলার দক্ষিণ রাজাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। এখন থাকেন ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের একটি বস্তিতে। তাঁর ভাষায়, “ভাঙনে জমি গেছিল, পরে ঘর। তৃতীয়বারে এলাম শহরে। কিন্তু শহরেও শান্তি নাই। কাজ নাই, আয় নাই, ঠিকানা নাই।”
মানবিক সংকট ও জীবনযাপনের সংগ্রাম—
এই বাস্তুচ্যুত মানুষদের একটি বড় অংশ এখন রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশালসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের বস্তিতে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। যেহেতু তাদের নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই, তারা সরকারি সহায়তার আওতার বাইরেও পড়ে যান অনেক সময়। নেই স্বাস্থ্যসেবা, নেই শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত হবে, যাদের একটি বড় অংশ ভোলা, বরগুনা, সাতক্ষীরা, কক্সবাজারের মতো উপকূলীয় অঞ্চল থেকে আসবে।
নারী ও শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ—-
বাস্তুচ্যুত নারীরা নানা ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বস্তিতে বসবাস করা নাজমা বেগম (৩৫) বলেন, “ভাঙনের পর শহরে এসে কাজ খুঁজছিলাম। কিন্তু অনেকেই খারাপ প্রস্তাব দিত। এখন বাসাবাড়িতে কাজ করি, কিন্তু নিরাপত্তার বোধ এখনো পাই না।” শিশুদের শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। স্কুলে ভর্তি হলেও দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান না থাকায় তারা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে না।
পুনর্বাসনের অভাবে দীর্ঘমেয়াদি সংকট—
সরকারিভাবে কিছু ত্রাণ সহায়তা ও অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হলেও, তা দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনের জন্য যথেষ্ট নয়। অনেক এনজিও উদ্যোগ নিয়েছে, তবে পরিকল্পনাহীন পুনর্বাসন অনেক সময় সমস্যার সমাধান না করে আরো সংকট তৈরি করছে।
করণীয় ও সুপারিশ—
১. জাতীয় জলবায়ু অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি নীতিমালা প্রণয়ন: স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুতদের স্বীকৃতি দিয়ে একটি কাঠামোগত পুনর্বাসন ব্যবস্থা প্রয়োজন।
২. জলবায়ু ফান্ডের কার্যকর ব্যবহার: আন্তর্জাতিক সাহায্য ও জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলকে কাজে লাগিয়ে উপকূলীয় এলাকায় প্রতিরোধমূলক কাজ এবং শহরে বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসনে বিশেষ কর্মসূচি চালু করা উচিত
৩ . সামাজিক সুরক্ষা সম্প্রসারণ: এসব মানুষের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও আইনগত সহায়তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৪ . কমিউনিটি ভিত্তিক পরিকল্পনা: বাস্তুচ্যুত মানুষদের অংশগ্রহণে এবং স্থানীয় বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে পুনর্বাসন পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।
উপসংহার—
ভোলার মতো উপকূলীয় জেলাগুলোর মানুষের জীবন থেকে সময় যেন কেটে নেওয়া হচ্ছে—নদীর স্রোতের মতোই। তারা বেঁচে আছেন, কিন্তু বেঁচে থাকার নিরাপত্তা ও সম্মান আজ বড় প্রশ্নের মুখে। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু একটি প্রাকৃতিক ইস্যু নয়, এটি একটি মানবাধিকার ও উন্নয়নের বড় চ্যালেঞ্জ। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে আগামীতে এই বাস্তুচ্যুতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজ এবং মানবিকতার ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দিতে পারে।
# লেখক, কবি, সাহিত্যিক , প্রফেসর