মোঃ মহিউদ্দিন
স্বাধীনতা শব্দটি শুধু একটি রাজনৈতিক বা সামাজিক অর্জনের নাম নয়; এটি এক অনন্ত অনুভূতির উৎস, যা কবি’র হৃদয়ে জ্বলে ওঠে এক অনির্বাণ শিখার মতো। স্বাধীনতা মানে শুধু শৃঙ্খলমোচন নয়, তা মানে মননের মুক্তি, কল্পনার অবাধ বিস্তার, ভাবনাগুলোর উন্মেষ এবং শব্দের স্বাধীন চলাচল।
কবি যখন স্বাধীনতার কথা বলেন, তখন তিনি বন্দিশালার শিকল ভাঙার চেয়েও গভীরতর কিছু বোঝান—তিনি বোঝান আত্মার মুক্তি, ভাষার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ, চেতনার আকাশে অসীম ডানার বিস্তার।
একজন কবি স্বাধীনতাকে দেখেন বহুমাত্রিক আলোয়।
রাজনৈতিক মুক্তির প্রেক্ষাপট ছাড়িয়ে স্বাধীনতা তাঁর কাছে এক ব্যক্তিগত, দার্শনিক, সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল ব্যাকুলতার প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ কবিতায় আমরা সেই মুক্তির এক নিখুঁত প্রতিচ্ছবি পাই—যেখানে মনুষ্যচেতনা সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এক মহত্তম উচ্চতায় পৌঁছাতে চায়। আর কাজী নজরুল ইসলাম? তিনি তো স্বাধীনতাকেই বুকে ধারণ করে দ্রোহের ভাষা নির্মাণ করেছেন, লিখেছেন—
“গাহি সাম্যের গান— মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!”
এই সাম্য, এই মুক্তিই তো প্রকৃত স্বাধীনতা!
স্বাধীনতা: এক চিরকালীন অন্বেষা–
একজন কবি স্বাধীনতাকে শুধু রাষ্ট্রের সীমারেখায় আটকে রাখেন না, বরং তিনি তা খোঁজেন ভাবনার গভীরে, হৃদয়ের অলিন্দে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যেমন আমরা দেখি নিসর্গের মধ্যে এক মুক্তির অনুরণন—
“আমি চেয়েছি কালো কালো চোখ দুটি—যেখানে স্বাধীনতার অন্ধকার গোপন আলো জ্বলে!”
এই স্বাধীনতা কি শুধুই দেশপ্রেমের এক অনুষঙ্গ? নাকি এর মধ্যে আছে আত্মপরিচয়ের এক অসীম বাসনা?
একজন কবি’র জন্য স্বাধীনতা মানে ভাষার স্বাধীনতা, সৃষ্টি করার অধিকার, ভাবতে পারার অবাধ সুযোগ। তিনি চান সমাজের নিপীড়ন, শোষণ, অন্যায় ও রুদ্ধদ্বার থেকে মুক্তি।
তিনি চান স্বপ্ন দেখার অধিকার। স্বাধীনতার সংজ্ঞা তাঁর কাছে তাই কখনো ব্যক্তিগত, কখনো সামাজিক, কখনো বা নিখাদ রোমান্টিক।
স্বাধীনতার কবিতা: এক শাশ্বত প্রতিধ্বনি–
যুগে যুগে কবি’র কলমেই স্বাধীনতার গান উচ্চারিত হয়েছে। হোমারের ইলিয়াড থেকে শুরু করে পাবলো নেরুদার বিপ্লবী কবিতা, রবীন্দ্রনাথের আত্মোপলব্ধির বাণী থেকে সুকান্ত ভট্টাচার্যের দুর্দম প্রতিবাদ—সবখানেই আমরা পাই স্বাধীনতার বহুরূপী রূপ।
এমনকি যখন কোনো রাষ্ট্র স্বাধীন হয়, তখনও কবি’র স্বাধীনতার অন্বেষা থামে না। কারণ রাষ্ট্রস্বাধীনতা পেলেও, ব্যক্তি কি সত্যিই মুক্ত? সমাজ কি সত্যিই সকলের জন্য স্বাধীন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার তাড়না থেকেই একেকজন কবি নতুন নতুন স্বাধীনতার সংজ্ঞা তৈরি করেন।
শেষ কথা—
স্বাধীনতা কোনো একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তের ফসল নয়; এটি এক নিরবিচার স্রোত, যা মানুষের হৃদয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। একজন কবি কখনো স্বাধীনতাকে জয়ের ভাষায় বলেন, কখনো স্বপ্নের, কখনো বা বেদনার। তবে এক সত্য চিরকাল একই থেকে যায়—কবি স্বাধীনতা ছাড়া বাঁচতে পারেন না। তাঁর কলম, তাঁর কাব্য, তাঁর কণ্ঠ—সবই স্বাধীনতার জন্য এক অনিরুদ্ধ আরাধনা।
তাই তো কবি লিখে যান, যুদ্ধ করেন, গর্জে ওঠেন কিংবা নীরবে নিভৃতে আঁকেন এক অনির্বচনীয় স্বাধীনতার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায়, মুক্তির পথে, অনন্তের দিকে।
লেখক# কবি ,সাহিত্যিক, প্রফেসর