আশিকুর রহমান শান্ত ভোলা প্রতিনিধিঃ
গত ২৪ আগস্টের ঘটনা। ভোলা সদর উপজেলার পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের ঘরপোড়া নামক স্থানের মোল্লা বাড়ির বাসিন্দা মোঃ রিয়াদ হোসেন এর স্ত্রী খাদিজার প্রসব বেদনা উঠে। খবর পেয়ে গ্রাম্য দাই একই এলাকার রাড়ী বাড়ির বাসিন্দা মৃত আবুল কালামের স্ত্রী জোসনা বেগম বাচ্চা প্রসব করাতে পারবেন বলে দাই সেবা দেওয়ার জন্য খাদিজার পরিবারকে বলেন। তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে খাদিজার পরিবার খাদিজাকে হাসপাতালে নেওয়ার পরিবর্তে বাড়িতে রেখে প্রসব করানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব হচ্ছিল না। তখন জোছনা বেগম টেনে জোর করে বাচ্চা বের করেন, যার নিরাপদ সন্তান প্রসবের ওপর কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। এতে খাদিজার ব্যাপক রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এক পর্যায়ে খাদিজার অবস্থা খারাপ দেখে তার পরিবার তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে অভিযুক্ত দাই জোছনা বেগম হাসপাতালে নেওয়া লাগবে না বলে সাব জানিয়ে দেন। তার কাছে অভিজ্ঞ ডাক্তার আছে বলে অন্য আরেকজন দাইকে তিনি নিয়ে আসেন। পরে রোগীর অবস্থা খারাপ দেখে জোছনা বেগম ঘটনা স্থল থেকে কেটে পড়েন। পরবর্তীতে কোন উপায়ান্ত না পেয়ে পরিবারের লোকজন খাদিজাকে ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সেখানের কর্তব্যরত চিকিৎসক দীর্ঘ চিকিৎসা দেওয়ার পর রোগীর অবস্থার অবনতি দেখে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে রেফার করেন। দীর্ঘ এক সপ্তাহ চিকিৎসা করানোর পরও এখন পর্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় বিছনায় পরে রয়েছেন খাদিজা বেগম। মা ও শিশু মৃত্যুর সাথে লড়াই করে প্রতিটি মুহূর্ত কাটাচ্ছে।
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত না হওয়ায় খাদিজার জীবনে এ করুণ পরিণতি ঘটেছে। শুধু খাদিজা নন, গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর সেবা সম্পর্কে সচেতনতা না থাকায় বহু নারী অকালে মৃত্যুবরণ করছেন। অথচ এই মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য।
নিরাপদ মাতৃত্ব বলতে বোঝায়, যেখানে একজন নারী নিজের সিদ্ধান্তে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা, যত্ন ও পুষ্টিকর খাবার পাবেন। যেমন—কমপক্ষে চারবার প্রসবপূর্ব চেকআপ, সন্তান প্রসবের সময়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ দাই (স্কিলড বার্থ অ্যাটেনডেন্ট বা মিডওয়াইফারি) দ্বারা সন্তান প্রসব এবং প্রসব-পরবর্তী সময়ে সঠিক পরিচর্যা। এরপরও যদি গর্ভকালে ও প্রসবকালে কোনো জটিলতা দেখা দেয়, প্রসব বাধাগ্রস্ত হয়, তবে তাঁকে জরুরি সেবার জন্য কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া।
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর ব্যাপারে আমাদের সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত হয়নি। জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এখনো সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি এক লাখে ১৭০ জন মা মারা যাচ্ছেন। গত কয়েক দশকে অবশ্য বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার ৬৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ১৯৭৫ সালে লাখে ৬০০ জন এবং ১৯৯০ সালে ৫৭৪ জন মায়ের মৃত্যু হয়েছে।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যায়, বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু বা মাতৃত্বজনিত অসুস্থতার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, বাড়িতে অদক্ষ দাইয়ের মাধ্যমে সন্তান প্রসব, মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে ও গর্ভধারণ, গর্ভকালীন ও প্রসব-পরবর্তী সময়ে সঠিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, যত্ন, পুষ্টির অভাব, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ না করা, অন্তঃসত্ত্বা মায়ের ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত সেবাসুবিধা না থাকা।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত দাই জোছনা বেগম এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কোন অন্যায় করিনি। আমি এরকম হাজার হাজার প্রসব করিয়েছি।